kalchitro
Bongosoft Ltd.
ঢাকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

কবি আহসান হাবীব : ক্রমরূপান্তরমান শিল্পসাধক


কালচিত্র | রফিকউল্লাহ খান প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২৪, ০৮:৪০ এএম কবি আহসান হাবীব : ক্রমরূপান্তরমান শিল্পসাধক

কবি আহসান হাবীব : ক্রমরূপান্তরমান শিল্পসাধক

রফিকউল্লাহ খান

 

কবি আহসান হাবীব : প্রয়াণদিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি (২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৭ - ১০ জুলাই ১৯৮৫)

ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার বিসর্পিল, অস্থির এবং আত্মরক্ষয়ী পথপরিক্রমায় কবিরা বর্তমানকে পেছনে ফেলে মুক্তি খুঁজেছিলেন দূরবর্তী পটভূমির আশ্রয়ে। সেখানে কখনো ছিল বিশ্ব-ঐতিহ্যের বিচিত্র হাতছানি, কখনো-বা প্রথম মহাসমরোত্তর ইউরোপীয় শিল্পের অনুকারী পদচারণা, আবার কখনো কখনো নতুনকে অঙ্গীকারের প্রয়াসে পৌরণিক উৎসের ঐকান্তিক আরাধনা ও পুনর্মূল্যায়ন। এই বিচিত্র গতির ঘূর্ণাবর্তে উত্তরণের সম্ভাবনা জীবনের চেয়ে ফর্ম-এর আশ্রয়েই প্রকাশ পেয়েছিল বেশি করে। অবশ্য সমগ্রতার অনুভবদীপ্ত একজন ব্যক্তির জীবনচর্চাও যে ইতিহাস, সভ্যতা ও সমাজকে কেন্দ্র করে উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে, কবিতার ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল নয়। তবুও আমাদের কবিদের কাছে জীবনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়েছিল শিল্পের―বিষয় অপেক্ষা শব্দব্যবহার ও প্রকরণের প্রতিই তাঁদের পক্ষপাত ছিল বেশি। এর কারণ, রাবীন্দ্রিক কাব্যপ্রভা অতিক্রম করার মতো আবেগ ও মনন তাঁদের ছিল না; পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথকেই নিজেদের সাম্প্রতিক অনুভবের মধ্যে চিবিত্রভাবে প্রত্যক্ষ করলেন তাঁরা। এই অক্ষমতা থেকেই তাঁদের মধ্যে জাগলো সুদূরের পিপাসা। কবিতার যেটুকু প্রাণশক্তি ত্রিশের কবিরা আহরণ করেছিলেন, তার সাফল্য ও সম্ভাবনা যেন এই দূরতর শিল্প ও ঐতিহ্যের অনুকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল। এবং তাঁদের এই প্রাণশক্তির গভীরেও পুঞ্জীভূত হয়েছিল এক অবক্ষয়ী আত্মপ্রতারণা―যা অতিক্রম করতে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল কবিদের। চল্লিশের দশকে এসে সেই অবরুদ্ধ প্রাণের মধ্যে জাগলো নব জীবনের উন্মাদনা―যে রূপ একবার উদাত্ত হয়ে উঠেছিল নজরুলের কাব্যগানের বাঁধাভাঙা উচ্ছ্বাসে, বিশের দশকে―নেতিবাচদের প্রবল মোহনীয় আবেষ্টনীকে ভেঙে ভেঙে বেরিয়ে এলেন নতুন যুগের কবিপুরুষেরা।

উল্লিখিত কাব্য-ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকার নিয়ে আহসান হাবীবের কবি-জীবনের সূচনা। বলা চলে, এই উত্তরাধিকারবোধের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া তাঁর প্রথম জীবনের কবিতায় একটা সমন্বয়ী শিল্পবিশ্বাসের কার্যকারণ হয়ে ওঠে। যার ফলে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ-এ (১৯৪৭, কলকাতা) ত্রিশোত্তর কাব্যধারার স্পন্দন যেমন সুস্পষ্ট, তেমনি, নবতর স্বপ্ননির্মাণের আকুলতাও বিদ্যমান। ‘বন্ধ্যা মাটির ক্ষীণ বিন্দুতে ঘূর্ণ্যমান’ যে সময়ের কথা কাব্যের সূচনাতে উচ্চারিত হয়, সেখানে চিরদহনের তিক্ত শপথ’ ও কালিক বাস্তবতা এবং শৈল্পিক উত্তরণের অনুষঙ্গেই যথার্থ মনে হয়। সেজন্য, নির্মম কোনো অভিজ্ঞতা বা অপ্রাপ্তি থেকে অনুকূল সত্যে পৌঁছার জন্য প্রত্যভিজ্ঞায় দীপ্ত হয়ে ওঠে কবিচৈতন্য। উত্তরাধিকার এবং সময় অভিজ্ঞতা কবির শিল্প-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক অভিক্ষেপ সূচিত করে। ইতিহাস এবং সমকাল সচেতন কবি, একটা কাব্য ধারারই অনিবার্য কার্যকারণশৃঙ্খলের প্রতিনিধিত্বকে নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেন :

ঝরা পালকের ধ্বংসস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়,

তবু বার বার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়,

তবু প্রত্যহ পীত অরণ্যে শেষ সূর্যের কণা,

মনের গহনে আনে বার বার রঙের প্রবঞ্চনা।

[এই মন-এই মৃত্তিকা]

এই ‘তবু’ একটা অভিজ্ঞানেরই ফলশ্রুতি। কেননা, শিল্পের অনুকারী অস্তিত্বের কাতরোক্তি তিনি শুনেছেন, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের পৌরাণিক মিলন-মোহনাসন্ধানী দুর্বোধ শিল্পের পথযাত্রাও অগোচরে ছিল না তাঁর―এজনেই ‘তবু’ দিয়ে তাঁকে যাত্রা শুরু করতে হয়। প্রত্যাশার পলাতক মুহূর্তগুলোকে সম্বল করে স্বপ্ন রচনা করতে হয় অপরূপ দিগন্তের―যদিও সেখানে ‘রঙের প্রবঞ্চনা’ পুরোপুরি অপসৃত হয় না। যে সকল কবি মন-মননকেই ইতঃপূর্বে শিল্পের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন― আহসান হাবীব তাঁদের থেকেও পৃথক যান। তাঁর ‘মন মৃত্তিকার সাহচর্যেই যথার্থ আশ্রয় প্রার্থনা করে। এই এই মৃত্তিকার সাহচর্যেই প্রাণশক্তি ‘খুঁজে পায় তাঁর কবিতা। শত হতাশ্বাস, দহনের তৃষ্ণা, বঞ্চনা এবং বেদনার মধ্যেও সুনিবিড় মাধুর্য আবিষ্কার করেন তিনি। যার ফলে, বিগতকাল এবং সমকালের কাব্যধারার নিগূঢ় উপলব্ধি সত্ত্বেও নিজের মতো করে প্রেরণার উৎসভূমি নির্মাণ করেন কবি। মাটির গন্ধ তাঁর ‘তনু মনে’ যে গভীর মোহ এবং অনুরণনের আয়োজন করে, তার ফলে ‍‍`কুতসিত‍‍` ও ‍‍`হীন কামনায়‍‍` ভস্মীভূত পৃথিবীতেও তিনি অন্বিষ্ট লাভে হয়ে ওঠেন আনন্দিত :

প্রেমহীন সেই বন্ধু দেশে নীড় বাঁধলাম তবু,

এই মন আর এ মৃত্তিকায় বিচ্ছেদ নাই কভু।

কবির এই শিল্পবিশ্বাসের পেছনে যুগপৎ কাজ করে গেছে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সমগ্রতাবাদী জীবনদর্শনসমূহ এবং সমকালীন জীবনের সমাজ-মানসিক উত্তেজনা ও উত্তরণ-আকাংক্ষা।

ত্রিশোত্তর কাব্য-প্রবাহের সঙ্গে আহসান হাবীবের তারুণ্যের উদ্দাম সময়গুলো সম্পর্কিত, সেজন্য এর প্রভাবকেও পুরোপুরি অতিক্রম করা তার পক্ষে অসাধ্য ছিল। কিন্তু হতাশা এবং বিমর্ষতার পরিবর্তে তিনি ক্ষোভ এবং জিজ্ঞাসাকেই প্রাধান্য দেন কবিতায়। সমকালের সমাজবাস্তবতার সঙ্গে কাব্য-ঐতিহ্যের সমীকরণ ঘটিয়ে বিস্ময়করভাবে, অনাগত সময়ের সূক্ষ্ম স্বপ্নেরও ইঙ্গিত দেন কখনো কখনো :

এখানে তোমার ছাউনি ফেলো না আজকে

                                            এটা বালুর চর,

চারিদিকে এর কৌটিল্যের কণ্টকময় বন ধূসর।

[আজকের কবিতা, ঐ]

হতাশা বা বিমর্ষতার পরিবর্তে এখানে আত্মপ্রত্যয়ী সুরই যেন অধিকতর স্পষ্ট। ভবিষ্যতের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতের সঙ্গে সঙ্গে নবতর বিষয় সন্ধানের আকুলতাও কবিসত্তায় স্পন্দিত হয়ে উঠেছে। ‘জঠরের জ্বালা চিরন্তন/চির ক্লেদাক্ত এই জীবন’ কবির কাছে কোনো তাত্ত্বিক মীমাংসা নয়, একটা স্বীকৃত বাস্তবতার হাত ধরে শিল্পের চোরাবালি অতিক্রমণের প্রয়াস। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‍‍`রাত্রিশেষ‍‍` কাব্যবিন্যাসে কবির প্রবণতা ব্যতিক্রমধর্মী এবং স্বতন্ত্র। ‘প্রহর’, ‘প্রান্তিক’, ‘প্রতিভাস’ এবং ‘পদক্ষেপ’―এই চারটি পর্যায়ে কাব্যকে বিন্যস্ত করে তার শিল্প ও বিষয়গত ক্রমযাত্রার স্বরূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। একজন চিত্রকর দৃষ্টি এবং অনুভবের সমন্বিত পরিচর্যায় জীবনকে যে প্রক্রিয়ায় রেখায়িত করেন ক্যানভাসে, কবিতার রূপ নির্মিতিতে আহসান হাবীব রঙ ও রেখার সেই আশ্চর্য শক্তিমত্তাকে গোড়া থেকেই অর্জন করেছিলেন।

‘সময়ের স্বর্ণ-ঈগল’ কবি আহসান হাবীবের প্রাহরিক আরাধনার স্বপ্নবস্তু। কেননা, তার অন্তর্গত চেতনার রঙে ‘সময়’ বিচিত্র অবয়ব নিয়ে ধরা দিয়েছে। ‘যাত্রা শেষের মঞ্জিল’ অজ্ঞাত হলেও কবির আত্মবিশ্বাস উচ্চারিত হয় অকুণ্ঠিতভাবে― ‘সময়ের পদধ্বনি আমাদের পুরোভাগে।‍‍` এই সময়ের অনুরণন আহসান হাবীবের কবিতায় অবিচ্ছিন্ন সূত্রের মতো স্পন্দমান। এই সময়বোধ তাঁর সুদীর্ঘ কাব্যপরিক্রমায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সুগভীর এই কালচেতনা―যা শৈল্পিক উত্তরণের অন্যতম মানদণ্ড―তাঁকে চল্লিশ দশকীয় কাব্যপরিধিতে স্বতন্ত্র করে রাখে। এই নিবিড় কাললগ্নতা সত্ত্বেও কবির বেদনাসিক্ত উচ্চারণ দৈনন্দিনতাকে অতিক্রম করে সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে। অতীতের আয়নায় ভবিষ্যৎকে প্রতিফলিত করে বর্তমানকে তিনি পরিণত করেন অন্তর্লীন যন্ত্রণার আধারে―যে বর্তমান শিল্পের সঙ্গতিকে প্রত্যাশা, অচরিতার্থতা ও বেদনার অভিঘাতে ব্যাহত করতে চায়। ‘কয়েদী’ মুহূর্তের যন্ত্রণাকে অঙ্গীকার করে কবির ‘পদক্ষেপ রচিত হয় মনের তটরেখা’ গুঁড়ায়ে, শিল্পের বাঁশরী’কে অসি হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে। যার ফলে, তারুণ্যের উন্মাদনাময় উচ্ছল কবি বলতে পারেন :

অতঃপর নির্ভীক নবীন

প্রত্যয়ের প্রতিজ্ঞায় একসূর্য অকুণ্ঠ আত্মায়

বহ্নিমান হয়ে ওঠে অবরুদ্ধ আকাশের গায়।

[মৃত্যু, ঐ]

সময় ও শিল্পের পরস্পরিত বিন্যাস আহসান হাবীবের শেষ পর্যায়ের : কবিতাকে যে ঐশ্বর্য এবং গাঢ়বন্ধতা দান করেছে―তার পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ সাধনার ইতিহাস। ‍‍`রাত্রিশেষ‍‍` কাব্যে যে জীবন উচ্চকিত, ক্ষুব্ধ এবং বর্তমানপীড়িত, পরবর্তী পর্যায়ে সেই জীবনাভিজ্ঞতা কবিতার অন্তর্গত শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বাইরের সংহত বিন্যাসের অন্তরালে জীবনের এই গভীর অনুরণন কবির শিল্প-অন্বেষার শীর্ষপ্রান্ত। জীবন ও শিল্পকে তিনি সুন্দরভাবে একীভূত করেছেন কবিতায় :

প্রতিজ্ঞা আমার

মুমূর্ষু মানুষে ডেকে জীবনের নতুন আহবান জানাবার।

আমার কণ্ঠস্বর সেথা নিত্য উচ্চতর হবে,

আমৃত্যু এ হাতছানি তোমাদের হাতে হাতে রবে।

[সাক্ষর, ঐ]

কবির এই প্রতিজ্ঞা কেবল জীবনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত নয়, প্রতিটি সময় বা যুগের শিল্পের সাম্প্রতিকতাকে নিবিড়ভাবে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

শিল্প আর মানুষ পরস্পরসংলগ্ন বিষয়। আহসান হাবীব তাঁর কবিতায় মানুষকে দেখেছেন অন্তর্গত উপলব্ধি দিয়ে―তাঁর কবিতাবিধৃত এবং উদ্ভবকাল থেকে―যে মানুষ ইতিহাস, সমকাল এবং ভবিষ্যতের আঙ্গিনায় একই সাথে সঞ্চরণশীল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমষ্টির সাথে একীভূত হয়ে চলার প্রশ্নে ব্যক্তি শিল্পীসত্তাই জয়ী হয়― নিজের স্বাতন্ত্র্যকে কবির সর্বজনীন শিল্পসমষ্টির অনুষঙ্গে পরিণত করেন। এ কারণেই, সমুদ্রের বিশালতায় বা জনতার গভীরে মিশে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রত্যাশা থাকে অনন্য হয়ে ওঠার। ছায়াহরিণ (১৯৬২), ও সারাদুপুর (১৯৬৪) কাব্যে কবিচেতনার এই বহুমাত্রিকতা স্থান করে নিয়েছে। সেখানে ঐতিহ্যবোধের সর্বব্যাপী সম্মোহন যেমন আছে, তেমনি আছে ব্যক্তিক ট্রাজেডির মধ্যেও সভ্যতা ও ইতিহাসের অনুরণন :

তনুর তনিমা ঘিরে আজ নেই হৃদয়ের ডাক

কুৎসিত কঙ্কাল ঘিরে ইতিহাস নগরী নির্বাক।

[ক্রান্তিকাল ছায়াহরিণ]

এবং ‘রক্তের অক্ষরে পথে সাক্ষরিত বহু ইতিহাস’-এর স্মৃতি ও বিন্যাসের বেদনা নিয়ে কবি শিল্পের আরেকটি পর্যায়ে উপনীত হন। কর্ডোভা, মিশর বা দূর ব্যাবিলনের স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে সভ্যতার একেকটি সংঘাত এবং পরিণামকে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। ইতিহাসের শিক্ষাকে হতাশার কার্যকারণ হিসেবে চিহ্নিত না করে গ্রহণ করে নিহত শক্তিসত্তাকে উজ্জীবিত করার উপলক্ষ হিসেবে। অন্য এক কবিতায় (প্রাজ্ঞ বণিকের প্রার্থনা) পৌরাণিক উৎসের কাছে বর্তমানলগ্ন জীবন ও আকাক্সক্ষার উত্তরণ কামনা করেছেন কবি। ‘শেষ সন্ধ্যা―প্রথম ঊষা’ কবির আত্মসমীকারই একটি উজ্জ্বল বাণীচিত্র যেন―যেখানে কালের কাছে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় সন্ধান করেন কবি :

তুমি কাল। অনন্তকালের

সঙ্গী নই আমি, তবু তার সঙ্গীদের

সঙ্গীত সভায় নিত্য জেগে রবে

মুগ্ধপ্রাণ আমি।

[শেষ সন্ধ্যা―প্রথম ঊষা, সারাদুপুর]

ছায়াহরিণ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায়ও অন্যতর বিন্যাসে একথাই যেন বলতে চেয়েছেন কবি :

আমিও নির্ভয়ে

অনেক ঢেউয়ের সঙ্গে আরেকটি অনন্য ঢেউ হতে পারি

এবং নির্ভয়ে আমিও মিলাতে পারি

এই কণ্ঠ পৃথিবীর সঙ্গীত সভায়।

[সমুদ্র অনেক বড়, ছায়াহরিণ]

এই সময় এবং সংগীত আহসান হাবীবের কবিতার মৌলিক অলংকার।

সময়ের প্রবহমানতা ও তার স্বরূপটিতে আহসান হাবীব পরিণত করেছেন চেতনার অবিচ্ছন্ন অংশে। যার ফলে, শিল্পের চিরায়তিক স্পন্দনের মধ্যে তাঁর কবিসত্তা বারবার উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। কালবৃত্তের খ- খ- অংশচূর্ণের মধ্যে একটা অখ- চৈতন্যের কলরব আবিষ্কার করেন তিনি। আশায় বসতি (১৩৮১) কাব্যগ্রন্থের সেই নৈঃশব্দের অন্তর্লীন শোকযাত্রা, বৈরী বাতাসে কম্পমান জীবনের উথালপাতাল আলোড়নের মধ্যে কবি এজন্যে রক্তিম আশার আলোয় উজ্জ্বল দিগন্ত প্রত্যক্ষ করেন। সময়ের প্রতিকূল বিন্যাস চলমান নৌকোর বৈঠার ছলাৎছল শব্দে ভেঙে ভেঙে যায়―উন্মোচিত হয় প্রত্যাশাদীপ্ত গতির পটভূমি :

এবার ফেরাবে মুখ বৈরী বাতাসের মুখ, ফেরাবে, শপথ।

অমলধবল পাল তুলে দেবে প্রাণের হাওয়ায়।

[বৈরী বাতাস, অতঃপর..., আশায় বসতি]

এই গতিমুখর অভিযাত্রা, প্রাণশক্তির এই অভিজ্ঞানদৃঢ় সংহতির মধ্যেও স্বকালের সংকটময় সমাজ-রাজনৈতিক আন্দোলন পথ করে নেয় অনায়াসে। শিল্পসুন্দর অভিনিবেশে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করার ফলে প্রাজ্ঞ চৈতন্য শব্দের গভীরে তরঙ্গিত করে তোলে জৈবনিক ট্রাজেডিকে, তার সমগ্রতাকে। প্লাবন, ধ্বংস, রক্তপাত এবং জাতীয় উত্তরণের সর্বময় পটভূমির মধ্যে কবির শিল্প যেখানে উচ্চকিত, আর্দ্র এবং প্রচারসর্বস্ব হয়ে ওঠার সম্ভাবনা, সেখানে কবি, জীবনের সমস্ত অসঙ্গতি ও ক্ষয়ক্ষতিকে শিল্পের অন্তর্ময় অনুষঙ্গে পরিণত করেন। জীবনের গতিচঞ্চল আবর্তের মধ্যে সীমাচিহ্নকে লুপ্ত করে দেন কবি : ‘নদীর সামান্য স্রোতে ভেসে ভেসে এইখানে এসে/ অতঃপর সমুদ্রের পেয়েছি সন্ধান’ (বিচ্ছিন্ন দ্বীপের আমরা)। কিন্তু স্ব-কাল সচেতন বলেই জীবনের সাম্প্রতিক বেদনা, বিপর্যয় ও নৈঃসঙ্গ্যকে অতিক্রম করতে পারেন না কবি―বিমূঢ় কবিচৈতন্য জিজ্ঞাসায়, বেদনায়, আর্তনাদে সম্মিলিত পথযাত্রার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংশয়ী হয়ে ওঠেন :

গলির এ পথ

কি করে পেরিয়ে যাবো জানি না সমুখে

অন্ধকার। ভয়। যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের

অন্ধকারে আমরা ক’টি বিভ্রান্ত নাবিক।

[ঐ]

তবুও তাঁর কাছে গতির দ্যোতক হয়ে বারবার ফিরে আসে নদী, মিছিল আর জোয়ারের অবিরল বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস।

অন্য এক কবিতায় (শিল্প মানবিক) কবি তাঁর আজীবন লালিত শিল্পদর্শনকে ব্যক্ত করেন, “শিল্প মানুষের জন্য মানুষ শিল্পের জন্য নয়।”

মেঘ বলে চৈত্র যাবো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থে আহসান হাবীবের কবিতা এক নতুন মোহনায় উপনীত। এ কাব্যে কবির দর্শন মানবিক সমগ্রতায় স্পন্দিত :

আমি এই পথ থেকে ফিরবো না, কেননা,

মানুষকে কোথাও না কোথাও যেতেই হয়

স্বকালসমৃদ্ধ এক সুস্থির আবাস তাকে

অবশ্যই গড়ে নিতে হয়

কোনো খানে।

[আমার তো কোথাও না কোথাও যেতে হবে]

কবির অভিনিবেশ কখনো ‘পবিত্র শোকের শবাধার’ এবং ‘গুলিবিদ্ধ হাজার করোটি’র স্পর্শে উজ্জীবিত, নদী নীলিমাকে ‘পারঙ্গম করতলে’ সুবিন্যস্ত ছবি হিসেবে নির্মাণ করে উচ্ছ্বসিত কখনো-বা; আবার কখনো কখনো স্মৃতি, বেদনা ও জৈবনিক ব্যর্থতার নিগূঢ় অভিক্ষেপে ক্লান্ত, অবসন্ন। কিন্তু তাকে উঠে আসতেই হয়, বেলুন-বন্দি, স্মৃতিকাতর শৈশবকে পেছনে ফেলে দাঁড়াতে হয় সেই বিশাল সময়ের বাঁকে বাঁকে―যেখানে ‘জীবনের বাগানে বাগানে নীর পথের বৈভব’ (বেলুন, ঐ) এভাবেই নীলিমার কাছে কবির আরাধনা অবয়ব খুঁজে পায়।

এ-কাব্যের ‘স্বাধীনতা’ নামক কবিতাটি কবির জীবনচেতনা, স্বাধিকারবোধ এবং শিল্প-অন্বেষার নিবিড় সমন্বয়ে হয়ে উঠেছে বাক্সময়, জীবন্ত। স্বাধীনতার অসম্ভব প্রাণশক্তির মধ্যে সচেতনভাবেই কবি সমকালীন শব্দবন্যার উচ্ছ্বাস কামনা করেন না। প্রাজ্ঞ কবি এজন্যই বলতে পারেন ‘শব্দের মালায় আমি তোমাকে গাঁথতে চাই স্বাধীনতা। তুমি/ঘরে-বাইরে এমন উলঝলুল নৃত্যে মেতে আছো, কি আশ্চর্য/আমার কলম/কিছুতেই তোমাকে যে ছুঁতেও পারে না’। আর অভীপ্সা ও অভিজ্ঞানের চূড়ান্ত পর্যায়ে কবি উচ্চারণ করেন―

মানব কল্লোলে আছি

যৌবনে জীবনে আছি

আশি ঋদ্ধ উৎসের উৎসবে।

[এই তীর্থে]

কবির শেষ পর্যায়ের কাব্যগ্রন্থ দু’হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০) সময়, জীবন এবং শিল্পের সমকাললগ্ন আকাক্সক্ষার প্রতিফলনেই কেবল স্বতন্ত্র নয়, একটা সর্বময় কাব্যদৃষ্টির বিন্যাসেও অনন্য।

আধুনিকতার প্রাণবিন্দু যে আবিষ্কারস্পৃহা―দু’হাতে দুই আদিম পাথর যেন সেই আবিষ্কারেরই শৈল্পিক প্রয়াস। এ কাব্যে সভ্যতা ও শিল্পের মৌলিক উৎসসমূহকে আধুনিক জীবন ও শিল্পবিন্যাসের সাথে পরস্পরিত করেছেন কবি। যে আদিম বস্তুখ-ের সম্মিলন বা সংঘাতে অন্ধকার অকর্ষিত পৃথিবী প্রথম আলোকোজ্জ্বল ও উৎপাদনশীল হলো, যার মধ্য দিয়ে সূচিত হলো সভ্যতার প্রথম সূর্যোদয়―পরিণত কবি সেই উৎসলোক থেকে কবিতার নবতর বিষয় আহরণ করেছেন। ইতিহাসের ধাবমানতার মধ্যে পৌরাণিক উৎসের অনুপুঙ্খ অন্তর্বয়নে কবিচৈতন্য এক সমগ্রতার বেলাভূমিতে উপনীত হয়েছে। এ কাব্যের ভাষায় যেমন আধুনিক তীক্ষèতা উপস্থিত, তেমনি, লোকজ এবং নাগরিক জীবনাচরণ ও বিশ্বাসের প্রতিফলনে এর বিষয় বা শিল্পেও লেগেছে নতুনত্বের ছন্দদোলা। বৃহত্তর জীবনভূমিকে দূরে ঠেলে দিয়ে ব্যক্তিগত চিত্তবৃত্তির বিন্যাসকেই যথার্থ মনে করেন না কবি। সেজন্য তাঁর স্মৃতি ও স্বপ্নের গন্তব্য, ‘ইথাকা, পেনেলোপি’ নির্দেশিত হলেও সমগ্রতার অনুভবে উজ্জীবিত কবি নির্দ্বিধায় জেগে ওঠেন সমকালীন জীবনচাঞ্চল্য ও শিল্প-অন্বেষার মধ্যে :

আমি কোনো আগান্তুক নই। এই

খররৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের

পাখিরা আমাকে চেনে

তারা জানে আমি কোনো আত্মীয় নই।

[আমি কোনো আগন্তুক নই]

মহৎ শিল্পী প্রতিটি কালে, লৌকিক বা লোকাত্তর পর্যায়ে যে কোনো অবস্থায়ই থাকুন না কেন―তাঁর অবস্থান শিল্পের মধ্য দিয়েই চিরন্তন মহিমা অর্জন করে। আহসান হাবীবের সবচেয়ে বড় সাফল্য এই আত্ম-শনাক্তিকরণ ও আত্ম-উন্মোচনের চিরায়তিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত।

 

Side banner