নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ
ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত
প্রকাশক: প্রগ্রেসিভ পাবলিসার্স
প্রচ্ছদ: পি দত্ত
প্রকাশকাল: ২০১২
২৭২ পৃষ্ঠা
দাম: ২০০টাকা
‘নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ’ বইটি ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত প্রণীত তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ঘরানার একটি গবেষণাসন্দর্ভ। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকারের ‘মুখবন্ধ’ বইটির গুরুত্ব কয়েকগুণ বাড়িয়েছে। অধ্যাপক ড. সিরাজুদ্দীন আমেদ’র তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ প্রায় আট বছর গবেষণা করে প্রস্তুত এই সন্দর্ভের জন্যে তিনি ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি উপাধি পান। তাঁর সন্দর্ভ মূল্যায়নে—দুই বাংলার স্বনামধন্য দুই উপভাষাবিজ্ঞানী ড. পবিত্র সরকার ও ড. মনিরুজ্জামান—প্রশংসা করে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সুপারিশ করেন । তার পরেও গবেষণা সন্দর্ভর্টি নিয়ে প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে তাঁকে এক যুগের অধিক সময়। কেননা আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে আমাদের অন্ধ আবেগ অসীম হলেও ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়নে অনীহাও সীমাহীন। অবশেষে, কলকাতার প্রগ্রেসিভ পাবলিসার্স থেকে এটি প্রকাশিত হয় ২০১২ খ্রিস্টাব্দে। আর বাংলাদেশে বইটি সুলভ হয় ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমান লেখকের কাছে লেখক তাঁর বইটি উপহার হিসেবে পাঠান—চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অধ্যাপক ও ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. অলক চক্রবর্তীর মাধ্যমে। তার আগে অভিসন্দর্ভটি মূল্যায়নের জন্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছেছিল পরীক্ষক ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামানের নিকট। তবে মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠানোর পর তাঁর সংগ্রহেও গবেষণা সন্দর্ভটি আর পাওয়া যায়নি। অবশ্য ২০২০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান লেখকের মাধ্যমে বইটির একাধিক কপি ড. মনিরুজ্জামানসহ চট্টগ্রামের ভাষাবিজ্ঞানীগণের কাছে পৌঁছেছে। বর্তমানে বাতিঘর লাইব্রেরি এবং রকমারি অনলাইন শপেও বইটি পাওয়া যাচ্ছে। তবে অদ্যাবধি বাংলাদেশে বইটির কোনো রিভিউ বা আলোচনা আমাদের নজরে আসেনি।
বইটির আলোচনায় প্রবেশের আগে বাংলার আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রবেশ করা প্রয়োজন। বাংলা উপভাষা তত্ত্বের প্রবাদপুরুষ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন। তাঁর ‘দ্যা ল্যাঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ এর পঞ্চম খন্ড (আসামী ও বাংলা) প্রকাশের বছরই (১৯০৩) ব্রিটিশ সরকার বাংলার উত্তর-পূর্ব-মধ্য-পশ্চিম চারটি পৃথক আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় পাঠশালার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের প্রয়াসে লিপ্ত হয়। বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদের প্রতিবাদে সে প্রচেষ্টা বাতিল করে ব্রিটিশ বঙ্গভঙ্গ করে ভৌগোলিক বিভাজনের পথে হাঁটে। বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদেই রবীন্দ্রনাথ (১৯০৫) বাংলার ভিন্ন ভিন্ন উপভাষার উপকরণ সংগ্রহ করে—প্রকৃত বাংলা ভাষার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ রচনার পথ প্রস্তুতের পরামর্শ পেশ করেন। সে প্রচেষ্টা আজও আলোর মুখ দেখেনি বটে; তবে তারও আগে থেকেই অনেক বাঙালি এই আহ্বানকে আমলে নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে স্ব স্ব আঞ্চলিক ভাষার ব্যাকরণসূত্র আবিষ্কারে আত্মনিয়োগ করেছেন। চট্টগ্রামের উপভাষার ইতিহাসে এধারার প্রথম বাঙালি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ৩য় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের অভিভাষণে তিনি চট্টগ্রামের ভাষার কয়েকটা সূত্র-নিয়ম উল্লেখ করে দেখান যে এভাষাও বাংলাভাষা। এরপর এটি আরও বিস্তৃত করে ব্যাকরণ-সূত্র উদাহরণসহ ধারাবাহিকভাবে (১৯১৮—১৯২১) ‘সওগাত’ পত্রিকায় ‘ইসলামাবাদ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদ পত্রিকায় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দেই প্রকাশিত হয় বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘চট্টগ্রামে প্রচলিত বঙ্গভাষা’ প্রবন্ধ এবং চণ্ডিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ঐ প্রবন্ধের সমালোচনা। সাহিত্যবিশারদের আলোচনাটি বই আকারে প্রকাশ পায় ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ মুর্তাজা আলীর সম্পাদানায়। এর ফলে আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৩৫) পুস্তিকা কিংবা ড. মুহম্মদ এনামুল হকের ‘চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য-ভেদ’ (১৯৩৫) গ্রন্থে সাহিত্যবিশারদের আঞ্চলিক ভাষা আলোচনা অনুপস্থিত। নারিহিকো উচিদা’র জর্মান ভাষায় প্রণীত অভিসন্দর্ভেরও (১৯৭০) অনুবাদ হয়নি। এমনকি এর পর বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রবন্ধে চট্টগ্রামের ভাষা প্রসঙ্গ আলোচিত হলেও ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত’র আগে চট্টগ্রামের উপভাষা নিয়ে বাংলা ভাষায় কোনো পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণাগ্রন্থ প্রণীত হবার সংবাদ পাওয়া যায়নি।
নোয়াখালি অঞ্চলের ভাষা নিয়ে প্রথম আলোচনা পাই গোপাল হালদার (১৯২৭) এবং আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ (১৯৮৫)-র আলোচনায়। গোপাল হালদার ও মনজুর মোরশেদ ছাড়া নোয়াখালি উপভাষার ওপর আর কারো মৌলিক আলোচনা নেই (শাহ কামাল, ২০০৭: ১৩)। তবে আলোচনা দুটি ইংরেজিতে হওয়ায় বাংলাদেশে এর তেমন প্রচার ঘটেনি—প্রভাবও পড়েনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ শ্রেণির (১৯৮৬) গবেষণাসন্দর্ভ—মোহাম্মদ শাহ কামাল ভুইঁয়া-র ‘নোয়াখালি উপভাষার সমাজ-ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা: সেনবাগের কৃষিজীবীর ভাষা’। এটি সমগ্র নোয়াখালির ভাষা নয়—বর্ণনামূলকও নয়—আলোচ্য গবেষণার আগে প্রকাশিতও (২০০৭) নয়। এ প্রসঙ্গে অনেকের আরেকটি আক্ষেপের কথা না বললে চলে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আড্ডায় আলোচনাটা শোনা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ইংরেজি বিভাগে ভাষাতত্ত্ব পড়ানো হয়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান, ছাত্র-পাঠ্য জনপ্রিয় ব্যাকরণ প্রণেতা ধ্বনিবিজ্ঞানী ড. শাহজাহান মনির, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়া ড. মো: আবুল কাসেম এবং বাংলা একাডেমির ব্যাকরণ প্রণেতাগণের অন্যতম ড. মাহবুবুল হক এখানে অধ্যাপনা করেন। অথচ এই অঞ্চলের কোনো উপভাষা নিয়ে এখানে কোনো পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণা হয়নি। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে: ড. মো.আবুল কাসেম ও ড. মাহবুবুল হক উভয়েই ড. মনিরুজ্জামানের ছাত্র। তবে তাঁদের কারো উচ্চতর একাডেমিক গবেষণার বিষয় ভাষাবিজ্ঞান নয়। মনিরুজ্জামানের মতো দীর্ঘকাল (১৯৬৮—২০০৭) বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যাপনার সুযোগও তাঁরা পাননি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভাষাতত্ত্ব সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মনিরুজ্জামান; ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক বাংলা পত্রিকা ‘নিসর্গ’-র প্রকাশক-সম্পাদকও তিনি। আঞ্চলিক ভাষা-গবেষণায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ড. মনিরুজ্জামান বাংলা বিভাগের সভাপতি থাকাকালে এমএ ক্লাসের বিশেষ প্রশিক্ষিত ছাত্রদের দিয়ে ‘ভাষাতাত্ত্বিক ফিল্ডওয়ার্ক ১৯৮৩’ নামে প্রান্তীয় অঞ্চলের ভাষা জরিপের চেষ্টাও করেছেন। তবু তাঁর আমলে এই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাগবেষক পেলাম না। অবশ্য ড. মনিরুজ্জামান অধ্যাপনা জীবনের আক্ষেপ অনেকটা শোধারনোর সুযোগ পেয়েছেন নিজের ‘চট্টগ্রামের উপভাষা’ (২০১৩) গবেষণাগ্রন্থ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের মাধ্যমে। ব্যতিক্রম কেবল শ্যামল কান্তি দত্ত’র ‘সিলেটের উপভাষা’ নিয়ে পিএইচডি (২০১৫), যা গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয় ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে । এপ্রসঙ্গে মোহাম্মদ নেয়ামত উল্যাহ ভূঁইয়ার এমফিল (২০১৪) অভিসন্দর্ভ ‘বৃহত্তর নোয়াখালীর ভাষা বৈচিত্র্য: পরিপ্রেক্ষিত ধ্বনিতত্ত্ব’ উল্লেখের দাবি রাখে। তবে এগুলো সবই আলোচ্য গবেষণাসন্দর্ভের পরের। এখানেই ড. রবীন্দ্র কুমার দত্তের গবেষণার গুরুত্ব।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ছাত্র (১৯১১) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অবিস্মরণীয় কীর্তি ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ (১৯৬৫) সম্পাদনা। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাবিষয়ক যেকোনো গবেষণার উপাত্তখনি হিসেবে গণ্য হয়। একথা স্মরণ রেখেও বলাযায় বাংলাভাষার দুটি আঞ্চলিক ভাষার তুলনামূলক আলোচনায় আলোচ্য বইটি পথপ্রদর্শক। কেননা প্রমিত বাংলার সাথে আঞ্চলিক ভাষার তুলনামূলক আলোচনা পেলেও প্রতিবেশি দুটি আঞ্চলিক ভাষা—যে ভাষাভাষীগণ আবার ‘একে অপরের ভাষা নিয়ে বিদ্রুপ করে থাকেন’—তেমন ভাষার তুলনা বাংলায় প্রথম বৈকি। গবেষকের মায়ের মুখের ভাষা নোয়াখালির উপভাষা আর প্রতিবেশির মুখের ভাষা চট্টগ্রামী। ফলে তিনি ‘নিজেই নিজের জ্ঞাপক বা ইনফর্মেট হিসেবে কাজ করেছেন’। তিনি প্রতিবেশি দুটো উপভাষা নিয়ে প্রচলিত উপহাসকে হাস্যরসে পরিণত করে ভাষাতত্ত্বের তাত্ত্বিক বিষয়ে তাঁর পাঠকে প্রবেশ করান। এতেকরে নীরস অ্যাকাডেমিক আলোচনার বইটিও হয়ে ওঠে সাধারণের সুখপাঠ্য।
বইটির শিরোনাম ‘নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষা: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ’ হলেও আসলে ভাষাবিজ্ঞানী ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত এখানে প্রমিত বাংলা উপভাষার সাথে নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের আলোকে। এ বইটি পাঠের মাধ্যমে পাঠকের মনে উপভাষা সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে। স্পষ্ট হবে ‘ভাষা বলতে কেন্দ্রীয় ও প্রান্তীয় সমস্ত উপভাষার মিলিত সম্ভার বোঝায়’। উপভাষা অপভাষা নয়, বরং প্রাকৃত ভাষা। বাংলা উপভাষা আলোচনায় গ্রিয়ার্সন, গোপাল হালদার, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ও নারিহিকো উচিদা’র বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতায় ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত উপভাষাতত্ত্বকে আরও গভীরতর করেছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অন্যদিকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যেমন বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়নের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব তেমনি বাংলার একধিক উপভাষার তুলনামূলক আলোচনা-গবেষণায় ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত পথিকৃতের দাবীদার। তাঁর আলোচনার ভাষাও প্রাঞ্জল-সরল হওয়াতে ভাষা বিষয়ে আগ্রহী যেকোনো পাঠকের কাছে বইটি সহজ পাঠ্য—সহজবোধ্য হতে বাধ্য।
লেখক পরিচিতি: ভাষাবিজ্ঞানী
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
সিইউএফ কলেজ, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
আপনার মতামত লিখুন :